দিশার খোঁজে ঘোড়ার আগে গাড়ি
আজব এই পৃথিবীর আজব সব নিয়ম-কানুন, তার থেকেও বড় আজব মানুষ নামক দুপায়ী প্রাণী। পৃথিবীর আয়তন যতবড় তার থেকেও ঢের পরিধির অধিকারী এই মানুষ। জীবন নামক রেলগাড়ির হাজারো বাঁকে হাজারো গল্পের সাক্ষী এই মানুষই। এই ছুটে চলার পথে অন্যান্য প্রাণী গোষ্ঠীর থেকে মানুষ অনেক উর্দ্ধে সে কথা নির্বিঘ্নে বলা যায়। এই গতিময়তায় সময়ের সাথে আপোসে লিপ্ত হতে খুব কমই দেখা গেছে মানুষকে। কখনো সময়ের সাথে তো কখনো সময়ের থেকে একধাপ এগিয়ে ভুবন জয়ের নেশায় লিপ্ত হয়েছে মানুষ। আর তখনই ভুবনের ভুলে ভারাক্রান্ত হয়ে প্রতিবারই হারিয়েছে তার গৌরব। নতুন দিশায় অমানিশার বিদায়ে আপামর জনতা পেয়েছে নব দিগন্তের সাক্ষাৎ। দিগন্তরেখার বিস্তৃত সীমারেখায় লক্ষ্য স্থির করে এগোতে হবে এ প্রজন্মকে।
হারানো গৌরব খুঁজে পাওয়ার কোন বৃথা চেষ্টাও এখন মানুষের মস্তিষ্কের আওতার বাহিরে। সবাই যখন জীবন নামক যুদ্ধে বোকার মতো নিজের বিজয়টাকে আসল বিজয় হিসেবে গণ্য করে, তখনই মানুষ হারায় তার দূরদর্শিতা। র্যাপিং পেপারে মোড়ানো কোন উপহারও মানুষ একটি বারের জন্য হলেও খুলে দেখে ভিতরে কি আছে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার থেকে পাওয়া আমাদের এই জীবন যে এক অমূল্য উপহার তা আমরা কখনো অনুভব করিনা, আর জীবন নামক উপহারের র্যাপিং খুলে দেখা তো দূরের কথা।
আমাদের বর্তমান অবস্থা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, খুঁটির গোড়ায় মাটি নেই। এটা বেশ কয়েক বছর আগে থেকে পরিষ্কার হয়ে উঠছে। দেশের সচেতন সমাজ এমনকি শিক্ষকেরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এই অনাকাঙ্ক্ষিত অনিশ্চিত ভবিষ্যতের। তবে আশার বিষয় হচ্ছে আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতা হিসেবে খ্যাত জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে অন্তবর্তী সরকারের হাত ধরে বেশকিছু পরিবর্তনের দেখা মিলছে। কিন্তু শংকার বিষয় হচ্ছে এই পরিবর্তন কতোটা স্থায়ীত্ব লাভ করে। পরিবর্তনের এই হাওয়া পরবর্তী সময়েও অপরিবর্তিত থাকলে শীঘ্রই সেই অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে প্রজন্মের সৈনিকেরা।
যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েলএক্সের মতে ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধির হারে এখন গর্বের সাথে শীর্ষ স্থান দখল করে নিয়েছে বাংলাদেশ। এই শীর্ষে থাকার তকমা আমাদের জন্য কতটা গর্বের তা আমরা নিজেরাও নির্ণয়ে একরকম ব্যর্থ। এই শীর্ষ স্থান দখল আমাদের জন্য আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ তা একটা পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। ওয়েলএক্সের গবেষণায় দেখা যায় ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধির হারে শীর্ষে থাকা বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ১৭.৩%,যেখানে ৮.১% প্রবৃদ্ধি নিয়ে তালিকার ১০ম স্থানে যুক্তরাষ্ট্র।বাংলাদেশের মোট প্রবৃদ্ধি যেখানে ৭.৩% সেখানে এই ১৭.৩% প্রবৃদ্ধি আমাদের জন্য অভিশাপই বটে। তবে বর্তমান বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনুস এর দূরদর্শিতায় এই প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির সূচক সকলকে নতুন করে আশার আলো দেখতে স্বপ্ন দেখাচ্ছে। নবগঠিত অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে তাই সকলের প্রত্যাশা সংস্কারের দরপত্রে আর কোন নিলাম না হোক, চাক্ষুষ হোক সুষ্ঠু পরিবর্তন।
সম্প্রতি প্রকাশিত গ্লোবাল ইনোভেশন ইনডেক্সে (২০১৮) বাংলাদেশের অবস্থান এশিয়ার সবচেয়ে নিচে। অর্থাৎ আমার দেশটি হলো উদ্ভাবনে সবচেয়ে পিছিয়ে। ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন এমনকি নেপালও আমাদের চেয়ে এগিয়ে। এই খবরটা যে কতটা উদ্বেগের, সেটা সম্ভবত আমাদের সরকার কখনোই উপলব্ধি করে না। আর আমরা জনগণ তো সেসব উদ্বেগে উদ্বেগিত হয় হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো, যা খুবই স্বল্পস্থায়ী। এই উদ্বেগ যদি স্থায়িত্ব লাভ করে তবে তা ভালোকিছুর প্রত্যাবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে।
স্বাধীনতার ৫৫ বছর পরে এসেও আমরা এখন গুটিকয়েক চক্রের কাছে একরকম জিম্মি। দেশের বর্তমান অবস্থায় দেশের জনগণ যে কোন অংশে কম দায়ী নয় তার কোন সন্দেহ নাই। যে কারণে দীর্ঘ ১৬ বছর ঘোড়ার আগে গাড়ির চালককে সুমিষ্ট ভাষায় সুদক্ষ চালক হিসাবে আখ্যা দিয়ে সে দীর্ঘশ্বাসকে আরো দীর্ঘ করেছে একটি মহল। তবে জনগণের মধ্যে নতুন আঙ্গিকে দেশপ্রেমের উদ্রেক আশার সঞ্চার করছে সকল মহলে। ঘোড়ার আগে আর গাড়ির চালককে নিয়োগ দেওয়া হবে না এই কল্পে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ জনতাই পারবে স্বাধীনতার প্রকৃত সুঘ্রাণ ছড়াতে।
ছুটে চলা গাড়ির চালক যেমন পিছনের আসনে বসে গাড়ির সঠিক গতিপথ নির্ধারণ করতে পারেন না ঠিক তেমনি আমরা আমাদের প্রকৃত সমস্যার বিশ্লেষণ ব্যতিরেকে সমাধান দিয়ে সাফল্যের আশা করতে পারি না। বিষয়টি সকলের নজরে এলেও সুনজরে আসেনি। তাই ভবিষ্যত বাংলাদেশ বিনির্মাণে সরকারের পাশাপাশি আমাদের সকলকে সতর্কতার সহিত সমস্যার মোকাবিলা করে জয়ের বন্দরে পৌঁছাতে হবে।
আসুন জীবন নামক যুদ্ধে বোকার মতো নিজের বিজয়টাকে আসল বিজয় হিসেবে গণ্য না করে স্বাধীনতার সময়ের আমাদের পূর্বপুরুষদের মতো সামগ্রিক বিজয়ে মনোনিবেশ করি।
লেখকঃ সাব্বির আহমেদ লেকচারার, বায়োটেকনোলজি বিভাগ, জার্মান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ