প্রতিমন্ত্রী সমীপে মুজিবনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রসংগ – হাসানুজ্জামান মালেক
গতকাল মুজিবনগর বিশ্ববিদ্যালয়, মেহেরপুর বিল জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে মেহেরপুরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আইনি ভিত্তি তৈরি হলো
গতকাল মুজিবনগর বিশ্ববিদ্যালয়, মেহেরপুর বিল জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে মেহেরপুরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আইনি ভিত্তি তৈরি হলো। রাষ্ট্রপতি হবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য। বিলে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজনে আচার্যের অনুমোদন নিয়ে ‘বিজনেস ইনকিউবেটর’ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে সব সহযোগিতা প্রদান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা শিক্ষার্থীর কোনো উদ্ভাবন, মেধাস্বত্ব, আবিষ্কার বা প্রক্রিয়া, বাজারজাত ও বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের জন্য সহযোগিতা দেবে। মুজিবনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান, কলা, মানবিক, সমাজবিজ্ঞান, আইন, ব্যবসায় প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা থাকবে বলে জানা গেছে। এই বিশ্ববিদ্যালয় জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, লিঙ্গ, জন্মস্থান বা শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নির্বিশেষে সব শ্রেণির দেশি ও বিদেশি উপযুক্ত শিক্ষার্থীর ভর্তি, জ্ঞানার্জন এবং ডিগ্রি, ডিপ্লোমা বা সার্টিফিকেট কোর্স শেষ করার পর সনদ প্রাপ্তির জন্য উন্মুক্ত থাকবে। মুজিবনগর বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কিত সকল তথ্য আমি আগ্রহভরে পর্যবেক্ষণ করে থাকি। প্রথমত: ১৯৭৮ সালে যখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাই- সেটা ছিল সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরোনোর মত সমস্যাসংকুল। যে কারণে সেকালে অনেক মেধাবী ও উপযুক্ত ছেলেমেয়ে সেই সমস্যা পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায়নি। এরকম একটা সুযোগ আমাদের ছেলেমেয়েরা দোর গোড়াতেই পাচ্ছে- এটা ভাবতেই ভাল লাগে। দ্বিতীয়ত: একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কারণে অনেক এলাকার আর্থ-সামাজিক অবস্থা বদলে গেছে তার উদাহরণ আছে ভুরিভুরি। কাজেই সেদিক থেকে মেহেরপুরের যে ইতিবাচক পরিবর্তন হতে চলেছে সেটা যেন আমি দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পাই। তৃতীয়ত: এলাকায় উচ্চ শিক্ষার হার বাড়বে, তরুন প্রজন্ম সম্পদে পরিণত হবে এবং একটি শিক্ষিত সুশীল নতুন আধুনিক সমাজ গড়ে উঠবে। চতুর্থত: বিশ্ববিদ্যালয়ের কারণে নূন্যপক্ষে ৫ হাজার শিক্ষিত মানুষের সমাগম হবে মেহেরপুরে। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের আবাসন, খাদ্য, নিত্যপন্য, ভোগ্যপন্য সরবরাহের নিমিত্ত এখানকার ব্যবসা-বাণিজ্য দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাবে। পঞ্চমত: বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে এলাকার বহু মানুষের কর্মসংস্থান হবে। সার্বিক বিচারে এই বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের সৌভাগ্যের দুয়ার খুলে দেবে বলে আমি বিশ্বাস করি। এখন প্রশ্ন হলো এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাদান কার্যক্রম কতটা যুগপোযুগী হবে। বস্তুত একটি আধুনিক, সুষম, উন্নত ও টেকসই সমাজ গড়তে চাই মানসম্পন্ন শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ মূল্যবোধসম্পন্ন জনবল। তবে আমাদের পরীক্ষানির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা সেই লক্ষ্যে তেমন উপযোগী নয় বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা সারা বছর পরীক্ষা নিয়েই ব্যস্ত থাকে, বুঝে পড়ার তেমন সময় নেই। ফলে আমাদের ছাত্ররা যতটা না শিক্ষাথী তার চেয়ে বেশি তারা পরীক্ষাথী। এছাড়া সমস্যা অনেক রয়েছে। আমাদের শিক্ষানীতির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন এখনও হয়নি। যুগের সাথে তালও মেলাতে পারিনি। বহুল আলোচিত চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে ধারণও করতে পারিনি। এই পরিবর্তন আর উন্মাদনার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হলে উপযুক্ত জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা দরকার। কর্মবাজারের কথাই ধরা যাক। পি ডব্লিউ সি নামের একটি চিন্তক প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, স্বয়ংক্রিয়করণ ও রোবটিকসের পাল্লায় ২০৩০ সালে বিশ্বের ৮০ কোটি বর্তমান চাকরিই নাই হয়ে যাবে। স্বভাবতই আমাদের মতো শ্রমনির্ভর অর্থনীতির দেশগুলো বিপদে পড়বে। অন্যদিকে নতুন ১০০ কোটি কর্মসৃজন হবে, তবে সেগুলো কেমন, তার বেশির ভাগই আমরা কল্পনা করতে পারছি না। মাত্র এক দশক আগেও কেউ ভাবতে পারেনি, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে লোককে ‘ফেসবুকে নজর রাখা’র জন্য চাকরি দেওয়া হবে। আমাদের চলমান ব্যবস্থায় ২০৩০ সালে আমরা এমন সব গ্র্যাজুয়েট তৈরি করব, সমাজে যাদের কোনো চাহিদাই থাকবে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে মোকাবিলা করতে হলে আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার খোলনলচে পাল্টে ফেলতে হবে; সৃজনশীলতা এবং বিশ্লেষণী ক্ষমতার বিকাশ ঘটাতে হবে; শিক্ষাকে করতে হবে অ্যাকটিভিটিনির্ভর এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে। জেনারেল কোর্সের থেকে প্রফেশনাল কোর্স অধিক গুরুত্বপূর্ণ – সেকথা এখন আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ঠিক এখানেই আমাদের মন্ত্রী অধ্যাপক ফরহাদ হোসেন মহোদয় সমীপে আবেদন যে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ উচ্চ শিক্ষার পাশাপাশি যেন জ্ঞান বিজ্ঞানের নতুন নতুন শাখায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষাদান, গবেষণা ও জ্ঞানের সৃজন, উৎকর্ষ সাধন ও বিতরণের ব্যবস্থা থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় বিলে উল্লিখিত প্রস্তাবনার বাস্তবায়ন হয় এবং প্রফেশনাল কোর্সের ওপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। স্মাট বাংলাদেশ গঠনের জন্য স্মাট সিটিজেন এর কোন বিকল্প নেই। বর্তমানে মেহেরপুরের প্রায় ৬০ হাজার স্বল্পশিক্ষিত ও অদক্ষ যুব সমাজ বিদেশে অভিবাসী হয়েছে। স্বল্প বেতনে চাকরী করেও ফরেন রেমিট্যান্স এনে দিচ্ছে। আগামী ৫ বছরে যদি আরও ৬০ হাজার দক্ষ যোগ্য জনশক্তি বিদেশে রপ্তানী করতে পারি তাহলে মেহেরপুরই হবে বাংলাদেশের সবচেয়ে সুখী-সমৃদ্ধ ও উন্নত জেলা। মাননীয় মন্ত্রী অধ্যাপক ফরহাদ হোসেন এর মাধ্যমে আমাদের অনেক স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিচ্ছে, অমিত সম্ভাবনার দ্বার খুলে যাচ্ছে। সেজন্য মন্ত্রী মহোদয়কে জানাই অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।